শ্রী কৃষ্ণের বহুবিবাহ


কৃষ্ণ রুক্মিণীকে পূর্বে বিবাহ করিয়াছিলেন, এক্ষণে এক  সম্যন্তক মণির প্রভাবে আর দুটি ভার্যা জাম্ববতী এবং সত্যভামা, লাভ করিলেন। ইহাই বিষ্ণুপুরাণ লেন, হরিবংশ এক পৈঠা উপর গিয়া থাকেন,—তিনি বলেন, দুইটি না, চারিটি। সত্রাজিতের তিনটি কন্যা ছিল,—সত্যভামা, প্রস্বাপিনী এবং ব্রতিনী। তিনটিই তিনি শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ করিলেন। কিন্তু দুই চারিটায় কিছু আসিয়া যায় না—মোট সংখ্যা নাকি ষোল হাজারের উপর। এইরূপ লোকপ্রবাদ।

বিষ্ণুপুরাণে ৪ অংশে আছে, “ভগবতোহ'প্যত্র মর্ত্যলোকেহবতীর্ণস্য ষোড়শসহস্রাণ্যেকোত্তরশতা—ধিকানি স্ত্রীণামভবন্।”- বিষ্ণুপুরাণ, ৪ অং, ১৫ অ, ১৯।
  কৃষ্ণের ষোল হাজার এক শত এক স্ত্রী।
 কিন্তু ঐ পুরাণের ৫ অংশের ২৮ অধ্যায়ে প্রধানাদিগের নাম করিয়া পুরাণকার বলিতেছেন, রুক্মিণী ভিন্ন “অন্যাশ্চ ভার্যাঃ কৃষ্ণস্য বভূবুঃ সপ্ত শোভনাঃ।” তার পর, “ষোড়শাসন্ সহস্রাণি স্ত্রীণামন্যানি চক্রিণঃ।” তাহা হইলে, দাঁড়াইল ষোল হাজার সাত জন। ইহার মধ্যে ষোল হাজার নরককন্যা। সেই আষাঢ়ে গল্প বলিয়া আমি ইতিপূর্বেই বাদ দিয়াছি।
গল্পটা কত বড় আষাঢ়ে, আর এক রকম করিয়া বুঝাই। বিষ্ণুপুরাণের চতুর্থ অংশের ঐ পঞ্চদশ অধ্যায়ে আছে যে, এই সকল স্ত্রীর গর্ভে কৃষ্ণের এক লক্ষ আশী হাজার পুত্র জন্মে। বিষ্ণুপুরাণে কথিত হইয়াছে যে, কৃষ্ণ এক শত পঁচিশ বৎসর ভূতলে ছিলেন। হিসাব করিলে, কৃষ্ণের বৎসরে ১৪৪০টি পুত্র, ও প্রতিদিন চারিটি পুত্র জন্মিত। এ স্থলে এইরূপ কল্পনা করিতে হয় যে, কেবল কৃষ্ণের ইচ্ছায় কৃষ্ণমহিষীরা পুত্রবতী হইতেন।
এই নরকাসুরের ষোল হাজার কন্যার আষাঢ়ে গল্প ছাড়িয়া দিই কিন্তু তদ্ভিন্ন আট জন “প্রধানা” মহিষীর কথা পাওয়া যাইতেছে। এক জন রুক্মিণী।বিষ্ণুপুরাণকার বলিয়াছেন, আর সাত জন। কিন্তু ৫ অংশের ২৮ অধ্যায়ে নাম দিতেছেন আট জনের, যথা—

“কালিন্দী মিত্রবিন্দা চ সত্যা নাগ্নজিতী তথা।
দেবী জাম্ববতী চাপি রোহিণী কামরূপিণী ||
মদ্ররাজসুতা চান্যা সুশীলা শীলমণ্ডনা।
সাত্রাজিতী সত্যাভামা লক্ষ্মণা চারুহাসিনী ||”

১।
কালিন্দী
৫।রোহিণী (ইনি কামরূপিণী)
২।মিত্রবিন্দা
৬।মদ্ররাজসুতা সুশীলা
৩।নগ্নজিৎকন্যা সত্যা
৭।সত্রাজিতকন্যা সত্যভামা
৪।জাম্ববতী
৮।লক্ষ্মণা

রুক্মিণী লইয়া নয় জন হইল। আবার ৩২ অধ্যায়ে আর এক প্রকার। কৃষ্ণের পুত্রগণের নামকীর্তন হইতেছে:—
প্রদ্যুম্নাদা হরেঃ পুত্রা রুক্মিণ্যাঃ কথিতাস্তব।
ভানুং ভৈমরিকঞ্চৈব সত্যাভামা ব্যজায়ত || ১||
দীপ্তিমান্ তাম্রপক্ষাদ্যা রোহিণ্যাং তনয়া হরেঃ।
বভূবুর্জাম্বুবত্যাঞ্চ শাম্বাদ্যা বাহুশালিনঃ || ২||
তনয়া ভদ্রবিন্দাদ্যা নাগ্নজিত্যাং মহাবলাঃ।
সংগ্রামজিৎপ্রধানাস্তু শৈব্যায়াস্ত্বভবন্ সুতাঃ || ৩||
বৃকদ্যাস্তু সুতা মাদ্র্যাং গাত্রবৎপ্রমুখান্ সুতান্।
অবাপ লক্ষ্মণা পুত্রাঃ কালিন্দ্যাঞ্চ শ্রুতাদয়ঃ || ৪||
এই তালিকায় পাওয়া গেল, রুক্মিণী ছাড়া,
১।সত্যভামা (৭)
৫।শৈব্যা (২)
২।রোহিণী (৫)
৬।মাদ্রী (৬)
৩।জাম্ববতী (৪)
৭।লক্ষ্মণা (৮)
৪।নাগ্নজিতী (৩)
৮।কালিন্দী (১)
কিন্তু ৪র্থ অংশের ‍১৫ অধ্যায়ে আছে, “তাসাঞ্চ রুক্মিণী-সত্যভামাজাম্ববতী-জালহাসিনীপ্রমুখা অষ্টৌ পত্ন্যঃ প্রধানাঃ।” এখানে আবার সব নাম পাওয়া গেল না, নূতন নাম “জালহাসিনী” একটা পাওয়া গেল। এই গেল বিষ্ণুপুরাণে। হরিবংশে আরও গোলযোগ।

হরিবংশে আছে;—
মহিষীঃ সপ্ত কল্যাণীস্ততোহন্যা মধুসূদনঃ।
উপষেমে মহাবাহুর্গুণোপেতাঃ কুলোদ্গতাঃ ||
কালিন্দীং মিত্রবিন্দাঞ্চ সত্যাং নাগ্নজিতীং তথা।
সুতাং জাম্ববতশ্চাপি রোহিনীং কামরূপিণীম্ ||
মদ্ররাজসুতাঞ্চাপি সুশীলাং ভদ্রলোচনাম্।
সাত্রাজিতীং সত্যভামাং লক্ষ্মণাং জালহাসিনীম্।
শৈব্যস্য চ সুতাং তম্বীং রূপেণাপ্সরসাং সমাং ||
               ১১৮ অধ্যায়ে, ৪০-৪৩ শ্লোকঃ।
এখানে পাওয়া যাইতেছে যে, লক্ষ্মণাই জালহাসিনী। তাহা ধরিয়াও পাই,—
১।কালিন্দী

৫।রোহিণী
২।মিত্রবিন্দী

৬।মাদ্রী সুশীলা
৩।সত্যা

৭।সত্রাজিতকন্যা সত্যভামা
৪। জাম্ববৎ-সুতা

৮।জালহাসিনী লক্ষ্মণা


৯)শৈব্যা


ক্রমেই শ্রীবৃদ্ধি-রুক্মিণী ছাড়া নয় জন হইল। এ গেল ১১৮ অধ্যায়ের তালিকা। হরিবংশে আবার ১৬২ অধ্যায়ে আর একটি তালিকা আছে, যথা—
অষ্টৌ মহিষ্যঃ পুত্রিণ্য ইতি প্রাধান্যতঃ স্মৃতাঃ।
সর্বা বীরপ্রজাশ্চৈব তাস্বপত্যানি মে শৃণু ||
রুক্মিণী সত্যভামা চ দেবী নাগ্নজিতী তথা।
সুদত্তা চ তথা শৈব্যা লক্ষ্মণ জালহাসিনী ||
মিত্রবিন্দা চ কালিন্দী জাম্ববত্যথ পৌরবী।
সুভীমা চ তথা মাদ্রী    *    *    *
ইহাতে পাওয়া গেল, রুক্মিণী ছাড়া,
(১)সত্যভামা

(৬)মিত্রবিন্দা
(২)নাগ্নজিতী

(৭)কালিন্দী
(৩)সুদত্তা

(৮)জাম্ববতী
(৪)শৈব্যা

(৯)পৌরবী
(৫)লক্ষ্মণা জালহাসিনী

(১০)সুভীমা


(১১)মাদ্রী

হরিবংশকার ঋষি ঠাকুর, আট জন বলিয়া রুক্মিণী সমেত বার জনের নাম দিলেন। তাহাতেও ক্ষান্ত নহেন। ইহাদের একে একে সন্তানগণের নামকীর্তনে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন আবার বাহির হইল—
(১২)সুদেবা।

(১৪)কৌশিকী
(১৩)উপাসঙ্গ

(১৫)সুতসোমা


(১৬)যৌধিষ্ঠিরী। (
ইঁহারাও প্রধানা অষ্টের ভিতর গণিত হইয়াছেন। ‘তাসামপত্যান্যষ্টানাং ভগবন্ প্রব্রবীতে মে।’ ইহার উত্তরে এ সকল মহিষীর অপত্য কথিত হইতেছে।)


এছাড়া পূর্বে সত্রাজিতের আর দুই কন্যা ব্রতিনী এবং প্রস্বাপিনীর কথা বলিয়াছেন।

এ ছাড়া মহাভারতের নূতন দুইটি নাম পাওয়া যায়—গান্ধারী ও হৈমবতী। 
             রুক্মিণী ত্বথ গান্ধারী শৈব্যা হৈমবতীত্যপি।
          দেবী জাম্ববতী চৈব বিবিশুর্জাতবেদসম্ ||
                     মৌসলপর্ব, ৭ অধ্যায়।

সকল নামগুলি একত্র করিলে, প্রধানা মহিষী কতকগুলি হয় দেখা যাউক। মহাভারতে আছে,—
(১)রুক্মিণী
(৪)শৈব্যা
(২)সত্যভামা
(৫)হৈমবতী
(৩)গান্ধারী
(৬)জাম্ববতী
মহাভারতে আর নাম নাই, কিন্তু “অন্যা” শব্দটা আছে। তার পর বিষ্ণুপুরাণের ২৮ অধ্যায়ে ১, ২, ৩, ছাড়া এই কয়েকটা নামও পাওয়া যায়।
(৭)কালিন্দী
(১০)রোহিণী
(৮)মিত্রবিন্দা
(১১)মাদ্রী
(৯)সত্যা নাগ্নজিতী
(১২)লক্ষ্মাণা জালহাসিনী
বিষ্ণুপুরাণের ৩২ অধ্যায়ে তদতিরিক্ত পাওয়া যায়, শৈব্যা। তাঁহার নাম উপরে লেখা আছে। তার পর হরিবংশের প্রথম তালিকা ১১৮ অধ্যায়ে, ইহা ছাড়া নূতন নাম নাই, কিন্তু ১৬২ অধ্যায়ে নূতন পাওয়া যায়।
(১৩)কালিন্দী

(১৪)রোহিণী


 (১৫)সভীমা

এবং ঐ অধ্যায়ে সন্তানগণনায় পাই,
(১৬)সুদেবা(১৮) কৌশিকী(২০)যৌধিষ্ঠিরী
(১৭)উপাসঙ্গ (১৯)সুতসোমা

এবং সত্যভামার বিবাহকালে কৃষ্ণে সম্প্রদত্তা,
(২১)ব্রতনী।  
(২২)প্রস্বাপিনী।


আট জনের জায়গায় ২২ জন পাওয়া গেল।

উপন্যাসকারদিগের খুব হাত চলিয়াছিল, এ কথা স্পষ্ট। ইহার মধ্যে ১৩ হইতে ২২ কেবল হরিবংশে আছে। এই জন্য ঐ ১০ জনকে ত্যাগ করা যাইতে পারে। তবু থাকে ১২ জন। গান্ধারী ও হৈমবতীর নাম মহাভারতের মৌসলপর্ব ভিন্ন আর কোথাও পাওয়া যায় না। মৌসলপর্ব যে মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত, তাহা পরে দেখাইব। এজন্য এই দুই নামও পরিত্যাগ করা যাইতে পারে। বাকি থাকে ১০ জন।

জাম্ববতীর নাম বিষ্ণুপুরাণের ২৮ অধ্যায়ে লেখা আছে,—
“দেবী জাম্ববতী চাপি রোহিণী কামরূপিনী।”
হরিবংশে এইরূপ,—
“সুতা জাম্ববতশ্চাপি রোহিণী কামরূপিণী।”

ইহার অর্থে যদি বুঝা যায়, জাম্ববৎসুতাই রোহিণী, তাহা হইলে অর্থ অসঙ্গত হয় না, এবং সেই অর্থই সঙ্গত বোধ হয়। অতএব জাম্ববতী ও রোহিণী একই। বাকি থাকিল ৮ জন।
সত্যভামা ও সত্যাও এক। তাহার প্রমাণ উদ্ধৃত করিতেছি।
সত্রাজিতবধের কথার উত্তরে
“কৃষ্ণঃ সত্যভামামমর্ষতাম্রলোচনঃ প্রাহ, সত্যে, মমৈষাবহাসনা।”
অর্থাৎ কৃষ্ণ ক্রোধারক্ত লোচনে সত্যভামাকে বলিলেন, “সত্যে! ইহা আমারই অবহাসনা।

পুনশ্চ পঞ্চমাংশের ৩০ অধ্যায়ে, পারিজাতহরণে কৃষ্ণ সত্যভামাকে বলিতেছেন,—
“সত্যে! যথা ত্বমিত্যুক্তং ত্বয়া কৃষ্ণাসকৃৎপ্রিয়ম্।”
আবশ্যক হইলে, আরও ভূরি ভূরি প্রমাণ দেওয়া যাইতে পারে। ইহা যথেষ্ট।

অতএব এই দশ জনের মধ্যে, সত্যা সত্যভামারই নাম বলিয়া পরিত্যাগ করিতে হইল। এখন আট জন পাই। যথা—
১।রুক্মিণী
৫।কালিন্দী
২।সত্যভামা
৬।মিত্রবিন্দা
৩।জাম্ববতী
৭।মাদ্রী
৪।শৈব্যা
৮।জালহাসিনী লক্ষ্মণা
ইহার মধ্যে পাঁচ জন—শৈব্যা, কালিন্দী, মিত্রবিন্দা, লক্ষ্মণা ও মাদ্রী সুশীলা—ইঁহারা তালিকার মধ্যে আছেন মাত্র। ইঁহাদের কখনও কার্যক্ষেত্রে দেখিতে পাই না। ইঁহাদের কবে বিবাহ হইল, কেন বিবাহ হইল, কেহ কিছু বলে না। কৃষ্ণজীবনে ইঁহাদের কোন সংস্পর্শ নাই। ইঁহাদের পুত্রের তালিকা কৃষ্ণপুত্রের তালিকার মধ্যে বিষ্ণুপুরাণকার লিখিয়াছেন বটে, কিন্তু তাঁহাদিগকে তখনও কর্মক্ষেত্রে দেখি না। ইঁহারা কাহার কন্যা, কোন্ দেশসম্ভূতা, তাহার কোন কথা কোথাও নাই। কেবল, সুশীলা মদ্ররাজকন্যা, ইহাই আছে। কৃষ্ণের সমসাময়িক  মদ্ররাজ, নকুল সহদেবের মাতুল, কুরুক্ষেত্রের বিখ্যাত রথী শল্য। তিনি ও কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রে সপ্তদশ দিন, পরস্পরের শত্রুসেনা মধ্যে অবস্থিত। অনেক বার তাঁহাদের সাক্ষাৎ হইয়াছে। কৃষ্ণ সম্বন্ধীয় অনেক কথা শল্যকে বলিতে হইয়াছে, শল্য সম্বন্ধীয় অনেক কথা কৃষ্ণকে বলিতে হইয়াছে। কৃষ্ণ সম্বন্ধীয় অনেক কথা শল্যকে শুনিতে হইয়াছে, শল্য সম্বন্ধীয় অনেক কথা কৃষ্ণকেও শুনিতে হইয়াছে। এক পলক জন্য কিছুতেই প্রকাশ নাই যে, কৃষ্ণ শল্যের জামাতা বা ভগিনীপতি, বা তাদৃশ কোন সম্বন্ধবিশিষ্ট। সম্বন্ধের মধ্যে এইটুকু পাই যে, শল্য কর্ণকে বলিয়াছেন, ‘অর্জুন ও বাসুদেবকে এখনই বিনাশ কর’। কৃষ্ণও যুধিষ্ঠিরকে শল্যবধে নিযুক্ত করিয়া তাহার যমস্বরূপ হইলেন। কৃষ্ণ যে মাদ্রীকে বিবাহ করিয়াছিলেন, ইহা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলিয়াই বোধ হয়। শৈব্যা, কালিন্দী, মিত্রবিন্দা এবং লক্ষ্মণার কুলশীল, দেশ এবং বিবাহবৃত্তান্ত কিছুই কেহ জানে না। তাঁহারাও কাব্যের অলঙ্কার, সে বিষয়ে আমার সংশয় হয় না।
কেন না, কেবল মাদ্রী নয়, জাম্ববতী, রোহিণী ও সত্যভামাকেও ঐরূপ দেখি। জাম্ববতীর সঙ্গে কালিন্দী প্রভৃতির প্রভেদ এই যে, তাঁহার পুত্র শাম্বের নাম, আর পাঁচ জন যাদবের সঙ্গে মধ্যে মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু শাম্ব  কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ, কেবল এক লক্ষ্মণাহরণে। লক্ষ্মণা দুর্যোধনের কন্যা। মহাভারত যেমন পাণ্ডবদিগের জীবনবৃত্ত, তেমনি কৌরবদিগেরও জীবনবৃত্ত।লক্ষ্মণাহরণে যদি কিছু সত্য থাকিত, তবে মহাভারতে লক্ষ্মণাহরণ থাকিত। তাহা নাই। লক্ষ্মণাহরণ ভিন্ন যদুবংশধ্বংসেও শাম্বের নায়কতা দেখা যায়। তিনিই পেটে মুসল জড়াইয়া মেয়ে সাজিয়াছিলেন। আমি এই গ্রন্থের সপ্তম খণ্ডে বলিয়াছি যে, এই মৌসলপর্ব প্রক্ষিপ্ত। মুসল-ঘটিত বৃত্তান্তটা অতিপ্রকৃত, এজন্য পরিত্যাজ্য। জাম্ববতীর বিবাহের পরে সুভদ্রার বিবাহ—অনেক পরে। সুভদ্রার পৌত্র পরিক্ষিৎ তখন ৩৬ বৎসরের, তখন যদুবংশধ্বংস। সুতরাং যদুবংশধ্বংসের সময় শাম্ব প্রাচীন। প্রাচীন ব্যক্তির গর্ভিণী সাজিয়া ঋষিদের ঠকাইতে যাওয়া অসম্ভব। জাম্ববতী নিজে ভল্লুককন্যা, ভল্লুকী। ভল্লুকী কৃষ্ণভার্যা বা কোন মানুষের ভার্যা হইতে পারে না। এই জন্য রোহিণীকে কামরূপিণী বলা হইয়াছে। কামরূপিণী কেন না, ভল্লুকী হইয়াও মানবরূপিণী হইতে পারিতেন। কামরূপিণী ভল্লুকীতে আমি বিশ্বাসবান্ নহি, এবং কৃষ্ণ ভল্লুককন্যা বিবাহ করিয়াছিলেন, তাহাও বিশ্বাস করিতে পারি না।
সত্যভামার পুত্র ছিল শুনি, কিন্তু তাঁহারা কোন কার্যক্ষেত্রে উপস্থিত নহেন। তাঁহার প্রতি সন্দেহের এই প্রথম কারণ। যবে সত্যভামা নিজে রুক্মিণীর ন্যায় মধ্যে মধ্যে কার্যক্ষেত্রে উপস্থিত বটে। তাঁহার বিবাহবৃত্তান্তও সবিস্তারে আলোচনা করা গিয়াছে।
মহাভারতের বনপর্বের মার্কণ্ডেয়সমস্যা-পর্বাধ্যায়ে সত্যভামাকে পাওয়া যায়। ঐ পর্বাধ্যায় প্রক্ষিপ্ত; মহাভারতের বনপর্বের সমালোচনাকালে পাঠক তাহা দেখিতে পাইবেন। ঐখানে দ্রৌপদীসত্যভামা সংবাদ বলিয়া একটি ক্ষুদ্র পর্বাধ্যায় আছে, তাহাও প্রক্ষিপ্ত। মহাভারতীয় কথার সঙ্গে তাহার কোন সম্বন্ধ নাই। উহা স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কিরূপ আচরণ কর্তব্য, তৎসম্বন্ধীয় একটি প্রবন্ধমাত্র। প্রবন্ধটার লক্ষণ আধুনিক।
তার পর উদ্যোগপর্বেও সত্যভামাকে দেখিতে পাই—যানসন্ধি-পর্বাধ্যায়ে। সে স্থানও প্রক্ষিপ্ত, যানসন্ধি-পর্বাধ্যায়ের সমালোচনা কালে দেখাইব। কৃষ্ণ, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বরণ হইয়া উপপ্লব্য নগরে আসিয়াছিলেন—যুদ্ধযাত্রায় সত্যভামাকে সঙ্গে আনিবার সম্ভাবনা ছিল না, এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যে সত্যভামা সঙ্গে ছিলেন না, তাহা মহাভারত পড়িলেই জানা যায়। যুদ্ধপর্ব সকলে এবং তৎপরবর্তী পর্ব সকলে কোথাও আর সত্যভামার কথা নাই।
কেবল কৃষ্ণের মানবলীলাসম্বরণের পর, মৌসলপর্বে সত্যভামার নাম আছে। কিন্তু মৌসলপর্বও প্রক্ষিপ্ত, তাহাও পরে দেখাইব।
ফলতঃ মহাভারতের যে সকল অংশ নিঃসন্দেহে মৌলিক বলিয়া স্বীকার করা যাইতে পারে, তাহার কোথাও সত্যভামার নাম নাই। প্রক্ষিপ্ত অংশ সকলেই আছে। সত্যভামা সম্বন্ধীয় সন্দেহের এই দ্বিতীয় কারণ।
তার পর বিষ্ণুপুরাণ। বিষ্ণুপুরাণে ইঁহার বিবাহবৃত্তান্ত স্যমন্তক মণির উপাখ্যানমধ্যে আছে। যে আষাঢ়ে গল্পে কৃষ্ণের সঙ্গে ভল্লুকসুতার পরিণয়, ইঁহার সঙ্গে পরিণয় সেই আষাঢ়ে গল্পে। তার পর কথিত হইয়াছে যে, এই বিবাহের জন্য দ্বেষবিশিষ্ট হইয়া শতধন্বা সত্যভামার পিতা সত্রাজিতকে মারিয়াছিলেন। কৃষ্ণ তখন বারণাবতে, জতুগৃহদাহপ্রবাদ জন্য পাণ্ডবদিগের অন্বেষণে গিয়াছিলেন। সেইখানে সত্যভামা তাঁহার নিকট নালিশ করিয়া পাঠাইলেন। কথাটা মিথ্যা। কৃষ্ণ তখন বারণাবতে যান নাই—গেলে মহাভারতে থাকিত। তাহা নাই। এই সকল কথা সন্দেহের তৃতীয় কারণ।
তার পর, বিষ্ণুপুরাণে সত্যভামাকে কেবল পারিজাতহরণবৃত্তান্তে পাই। সেটা অনৈসর্গিক অলীক ব্যাপার; প্রকৃত ও বিশ্বাসযোগ্য ঘটনায় তাঁহাকে বিষ্ণুপুরাণে কোথাও পাই না। সন্দেহের এই চতুর্থ কারণ।
মহাভারতে আদিপর্বে সম্ভব-পর্বাধ্যায়ে সপ্তষট্টি অধ্যায়ের নাম ‘অংশাবতরণ’। মহাভারতের নায়কনায়িকাগণ কে কোন্ দেব দেবী অসুর রাক্ষসের অংশে জন্মিয়াছিল, তাহাই ইহাতে লিখিত হইয়াছে। শেষ ভাগে লিখিত আছে যে, কৃষ্ণ নারায়ণের অংশ, বলরাম শেষ নাগের অংশ প্রদ্যুম্ন সনৎকুমারের অংশ, দ্রৌপদী শচীর অংশ, কুন্তী ও মাদ্রী সিদ্ধি ও ধৃতির অংশ। কৃষ্ণমহিষীগণ সম্বন্ধে লেখা আছে যে, কৃষ্ণের ষোড়শ সহস্র মহিষী অপ্সরাগণের অংশ এবং রুক্মিণী লক্ষ্মী দেবীর অংশ। আর কোনও কৃষ্ণমহিষীর নাম নাই। সন্দেহের এই পঞ্চম কারণ। সন্দেহের এ কারণ কেবল সত্যভামা সম্বন্ধে নহে। রুক্মিণী ভিন্ন কৃষ্ণের সকল প্রধানা মহিষীদিগের প্রতি বর্তে। নরকের ষোড়শ সহস্র কন্যার অনৈসর্গিক কথাটা ছাড়িয়া দিলে, রুক্মিণী ভিন্ন কৃষ্ণের আর কোনও মহিষী ছিল না, ইহাই মহাভারতের এই অংশের দ্বারা প্রমাণিত হয়।
ভল্লুকদৌহিত্র শাম্ব সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছি, তাহা বাদ দিলে, রুক্মিণী ভিন্ন আর কোনও কৃষ্ণমহিষীর পুত্র পৌত্র কাহাকেও কোন কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় না। রুক্মিণীবংশেই রাজা হইল—আর কাহারও বংশের কেহ কোথাও রহিল না।
এই সকল কারণে আমার খুব সন্দেহ যে, কৃষ্ণের একাধিক মহিষী ছিল না।  ইহা নিশ্চিত বটে যে, সচরাচর অকারণে পুরুষের একাধিক বিবাহ অধর্ম। কিন্তু সকল অবস্থাতে নহে। যাহার পত্নী কুষ্ঠগ্রস্ত বা এরূপ রুগ্ন যে, সে কোন মতেই সংসারধর্মের সহায়তা করিতে পারে না, তাহার যে দারান্তপরিগ্রহ পাপ, এমন কথা আমি বুঝিতে পারি না। যাহার স্ত্রী ধর্মভ্রষ্টা কুলকলঙ্কিনী, সে যে কেন আদালতে না গিয়া দ্বিতীয় বার দারপরিগ্রহ করিতে পারিবে না, তাহা আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আসে না। আদালতে যে গৌরববৃদ্ধি হয়, তাহার উদাহরণ আমরা সভ্যতর সমাজে দেখিতে পাইতেছি। যাহার উত্তরাধিকারীর প্রয়োজন, কিন্তু স্ত্রী বন্ধ্যা, সে যে কেন দারান্তর গ্রহণ করিবে না, তা বুঝিতে পারি না। ইউরোপ যিহুদার নিকট শিখিয়াছিল যে, কোন অবস্থাতেই দারান্তর গ্রহণ করিতে নাই। যদি ইউরোপের এ কুশিক্ষা না হইত, তাহা হইলে, বোনাপার্টিকে জসেফাইনের বর্জনরূপ অতি ঘোর নারকী পাতকে পতিত হইতে হইত না; অষ্টম হেন্‌রীকে কথায় কথায় পত্নীহত্যা করিতে হইত না। ইউরোপে আজি কালি সভ্যতার উজ্জ্বলালোকে এই কারণে অনেক পত্নীহত্যা, পতিহত্যা হইতেছে। আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, যাহাই বিলাতী, তাহাই চমৎকার, পবিত্র, দোষশূন্য, ঊর্ধাধঃ চতুর্দশ পুরুষের উদ্ধারের কারণ। আমার বিশ্বাস, আমরা যেমন বিলাতের কাছে অনেক শিখিতে পারি, বিলাতও আমাদের কাছে অনেক শিখিতে পারে। তাহার মধ্যে এই বিবাহতত্ত্ব একটা কথা।
কৃষ্ণ একাধিক বিবাহ করিয়াছিলেন কি না, সে বিষয়ে কোন গণনীয় প্রমাণ নাই, ইহা দেখিয়াছি। যদি করিয়া থাকেন, তবে কেন করিয়াছিলেন, তাহারও কোন বিশ্বাসযোগ্য ইতিবৃত্ত নাই। যে যে তাঁহাকে স্যমন্তক মণি উপহার দিল, সে সঙ্গে সঙ্গে অমনি একটি কন্যা উপহার দিল, ইহা পিতামহীর উপকথা। আর নরকরাজার ষোল হাজার মেয়ে, ইহা প্রপিতামহীর উপকথা। আমরা শুনিয়া খুশি—বিশ্বাস করিতে পারি না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ