শ্রীকৃষ্ণই যে ঈশ্বর, তার প্রমান কী ?

শ্রীকৃষ্ণই যে ঈশ্বর, তার প্রমান কী ?
শ্রীকৃষ্ণ জন্ম নেন, কঠিন পাহারায় আবদ্ধ তালাবদ্ধ কারাগারে, জন্মের পরই সমস্ত তালা খুলে যেখান থেকে সে বেরিয়ে আসে সম্পূর্ণ অলৌকিকভাবে, এটা কি সর্বশক্তিমান ঈশ্বর না হলে কারো পক্ষে ঘটানো সম্ভব ?
কৃষ্ণের পিতা যখন তাকে নিয়ে কারাগারের বাইরে আসে তখন সমস্ত প্রহরী, এমনকি রাজা কংসও ছিলো গভীর ঘুমে নিদ্রিত এবং সে যখন কৃষ্ণকে মাথায় নিয়ে বর্ষার সময়ের ভরা নদী সাঁতরে পার হতে যাচ্ছিলেন, তখন নদীর জল দুই ভাগ হয়ে পথ তৈরি হয়েছিলো এবং সেই পথ দিয়ে নদী পার হয়ে বসুদেব, কৃষ্ণকে গোকূলে রেখে আবার নিরাপদে কারাগারে পৌঁছলে আবার আগের মতো সব তালা যেখানে যা ছিলো সেভাবে লেগে যায়, এটা কি সর্বশক্তিমান ঈশ্বর না হলে কারো পক্ষে ঘটানো সম্ভব ?
প্রায় ১০ বছরের পরিকল্পনা সত্ত্বেও কারাগারে শ্রীকৃষ্ণকে হত্যা করতে না পেরে, কংস, গোপনে বিভিন্ন রাক্ষস পাঠিয়ে শিশু কৃষ্ণকে হত্যা করার চেষ্টা করে; কিন্তু সেই সব রাক্ষসদেরকে শ্রীকৃষ্ণ নিজেই হত্যা করে, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর না হলে কেউ কি নিজেকে এভাবে রক্ষা করতে পারে ?
কৃষ্ণ যখন সবে মাত্র হামাগুড়ি দিয়ে চলতে শিখেছে, সেই সময় সে, দুই গাছের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় বাধা প্রাপ্ত হলে, দুইটা বড় বড় অর্জুন গাছ উপড়ে ফেলে, এটা কি সর্বশক্তিমান ঈশ্বর না হলে কারো পক্ষে করা সম্ভব ?
কৃষ্ণ মাত্র তিন বছর আট মাস বয়সে, যে বয়সে শিশুরা সাঁতার কাটতেও শিখে না, সেই বয়সে এক জলাশয়ের জলে ঝাঁপ দিয়ে কালীয় নামের এক ভয়ংকর সাপকে বশে এনে তাকে ঐ জলাশয় ছেড়ে যেতে বাধ্য করে, এটা কি সাধারণ কারো পক্ষে করা সম্ভব ?
কৃষ্ণের যখন ৭ বছর বয়স, তখন সে একটি পর্বত হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুলের উপর ৭ দিন ধরে তুলে রেখেছিলো, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর না হলে এটা কারো পক্ষে কিভাবে ঘটানো সম্ভব ? তিনি তো আর দেহের শক্তিতে ঐ পর্বত তুলে রেখেছিলেন না, রেখেছিলেন মনের শক্তির জোরে। এই শক্তি সাধারণ মানুষ পাবে কোথায় ?
১০ বছর ২ মাস বয়সে কৃষ্ণ, কংসের মতো এক শক্তিশালী রাজাকে মল্ল যুদ্ধে পরাজিত করে। এই সময় কৃষ্ণের বাবা মাকে রাখা হয়েছিলো বলি দেওয়ার মতো করে হাড়ি কাঠে মাথা দেওয়া অবস্থায়; কংসের নির্দেশ ছিলো, তার জীবন সংশয় দেখা দিলেই যেন সেই জল্লাদরা কৃষ্ণের বাবা মায়ের মাথা কেটে ফেলে, কিন্তু সেই সময় শুধু কৃষ্ণের চোখের ইশারায়, গলা কাটতে গিয়ে জল্লাদরা ছিটকে পড়ে যায় এবং কৃষ্ণের বাবা মা বেঁচে যায়; সর্বশক্তিমান ঈশ্বর না হলে এই ঘটনা সে কিভাবে ঘটাতে পারলো ?
এর আগে কৃষ্ণ মথুরায় পৌঁছেই এক পঙ্গু মহিলার দেহ স্পর্শ করেই তাকে সুস্থ করে তোলেন, এটা কি সর্বশক্তিমান ঈশ্বর না হলে কারো পক্ষে করা সম্ভব ?
কৃষ্ণের সমগ্র জীবনই ছিলো তার নিজের পরিকল্পনার ফল, এজন্য তিনি কোনোদিন এক কথা দুইবার বলেন নি বা কোনো সিদ্ধান্তকে চেঞ্জ করেন নি, কেউ যদি তার বর্তমান ও ভবিষ্যত না জানে, তার পক্ষে কি এভাবে নিজের জীবনের পরিকল্পনা করা সম্ভব ?
কৃষ্ণ, ঈশ্বর হিসেবে ছিলেন সর্বজ্ঞানী, তাই তিনি কাল যবন নামক এক অসুরের মৃত্যু কিভাবে হবে তা জানতেন, এজন্য নিজের বোন সুভদ্রাকে হত্যা করার চেষ্টা করলেও কৃষ্ণ তার সাথে কোনো রকম যুদ্ধ না ক’রে, নিজে ঢুকে যান এক গুহার মধ্যে যেখানে নিদ্রিত ছিলেন মুচকুন্দ নামের এক ঋষি, যিনি বহুদিন ধরে চোখ বন্ধ করে তপস্যা করছিলেন, কাল যবন সেই গুহায় ঢুকে সেই মুচকুন্দকে কৃষ্ণ মনে করে লাথি দিয়ে জাগাতেই সেই ঋষি চোখ খুলে এবং তার দৃষ্টি কাল যবনের উপর পরতেই সে অগ্নিতে ভস্ম হয়ে মারা যায়। কৃষ্ণ, সর্বজ্ঞানী না হলে কালযবনের এই মৃত্যু রহস্য তিনি জানতে পারতনে না এবং এই ঘটনা তিনি কিছুতেই ঘটাতে পারতেন না।
দ্রৌপদীর জন্মের পর, দ্রুপদ রাজা যখন দ্রৌপদীকে মেনে নিচ্ছিলো না, তখন কৃষ্ণ পাঞ্চালে যায় দ্রুপদকে সাইজ করতে, সে তার গদাকে শূন্যে চালিয়ে একাই দ্রুপদের পুরো বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে দ্রুপদকে হত্যা করতে যায়, যার ফলে দ্রুপদ রাজা কৃষ্ণের কাছে নতি স্বীকার করে; কৃষ্ণ সর্বশক্তিমান ঈশ্বর না হলে এটা সে কিভাবে করতে পারলো ?
দ্রৌপদীকে হস্তিনাপুরের রাজ সভায় যখন বিবস্ত্র করার চেষ্টা হচ্ছিলো, তখন আর কোনো উপায় না দেখে দ্রৌপদী শুধু কৃষ্ণকে স্মরণ করে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলো, কৃষ্ণ সেখানে উপস্থিত না থাকলেও, দ্রৌপদী তাকে স্মরণ করেছে ব’লে, কৃষ্ণ তার অলৌকিক শক্তি দ্বারা এত কাপড় দিয়ে দ্রৌপদীকে ঢেকে দিয়েছিলো যে দুঃশাসন, দ্রৌপদীর কাপড় ধরে টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে গিয়েছিলো, তবু তাকে বস্ত্রহীন করতে পারে নি; সর্বশক্তিমান হিসেবে কৃষ্ণ যদি এই ঘটনা না ঘটায়, তাহলে এটা কিভাব সম্ভব হয়েছিলো ?
পাশা খেলায় ছলের মাধ্যমে শকুনি-দুর্যোধন যখন, পাণ্ডবদের রাজ্য কেড়ে নিয়ে তাদেরকে ১২ বছরের জন্য বনে নির্বাসন দিয়েছিলো, সেই সময় পাণ্ডবদের বাড়িতে যায় ঋষি দুর্বাসা তার অগুনতি শিষ্য নিয়ে এবং বলে আমাদেরকে খেতে দাও, আমরা ক্ষুধার্ত। কিন্তু একটু আগেই তারা নিজেদের খাওয়া শেষ করেছে, তাই ঘরে আর কোনো খাবার ছিলো না এবং নতুন করে খাবার প্রস্তুত করার মতো খাদ্য সামগ্রীও ছিলো না। আবার কাউকে অসন্তুষ্টভাবে বিদায় দেওয়াও গৃহস্থের জন্য অমঙ্গল, এই অবস্থায় উভয় সংকটে প’ড়ে দ্রৌপদী ও পাণ্ডবরা ঋষিদেরকে পাতা পেরে বসতে দিয়ে এখনই খাবার পরিবেশন করবে এমন একটা ভাব করে যাচ্ছিলো, কিন্তু ঘরে তো কোনো খাবার নেই, তারা খাবার দেবে কোথা থেকে ? পরমভক্ত হওয়ায়, কৃষ্ণ আগেই দ্রৌপদীকে কথা দিয়ে রেখেছিলো, যখনই সে কোনো সমস্যায় পড়বে, তাকে স্মরণ করা মাত্র, কৃষ্ণ তার সহায়ে উপস্থিত হবে বা সহায়তা করবে। তাই দ্রৌপদী কৃষ্ণক স্মরণ করা মাত্র কৃষ্ণ সেখানে উপস্থিত হয় এবং হাড়িতে অবশিষ্ট থাকা মাত্র একটি ভাত নিজে খেলে সকল ঋষির পেট ভরে যায় এবং সকল ঋষি সন্তুষ্ট হয়ে সেই স্থান ত্যাগ করে। কৃষ্ণ যদি ঈশ্বর না হয়, তার পক্ষে এই ঘটানো কিভাবে ঘটানো সম্ভব ?
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যখন অবশ্যম্ভাবী, তখন পাণ্ডবদের পক্ষ থেকে শান্তি প্রস্তাব নিয়ে কৃষ্ণ যায় হস্তিনাপুরের রাজসভায় এবং বলে মাত্র ৫ টি গ্রাম পাণ্ডবদেরকে দিলে এই যুদ্ধ আর হবে না। কিন্তু এই ৫ টি গ্রামও দুর্যোধন, পাণ্ডবদেরকে দিতে রাজী ছিলো না এবং দুর্যোধন বলেছিলো, বিনা যুদ্ধে নাহি দেবো সূচাগ্র মেদিনী। শুধু তাই নয়, কৃষ্ণই পাণ্ডবদের মূল শক্তি, এটা বুঝতে পেরে শকুনি ও দুর্যোধন আগে থেকেই প্ল্যান করে রেখেছিলো কৃষ্ণকে কারাগারেব বন্দী করে রাখার এবং সেই মোতাবেক, দুর্যোধন, কৃষ্ণকে লোহার মোটা শিকল দিয়ে বন্দী করে যখন কারাগারে বন্দী করে, তখন সে দেখে কারাগারের ভেতর কৃষ্ণের বদলে দুঃশাসন। কৃষ্ণ যদি সর্বশক্তিমান না হয় তাহলে সে ওখান থেকে কিভাবে নিজেকে মুক্ত করতে পারলো ?
অনেকেই এটা ভেবে পায় না যে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে, কৃষ্ণ কিভাবে অত সময় ধরে অর্জুনকে গীতার জ্ঞান দান করার সময় পেলো এবং তাকে বিশ্বরূপ দেখালো; কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত আর কেউই গীতার বাণী শুনতে পেলো না, এমন কি তার বিশ্বরূপও দেখতে পেলো না ?
যাদের মনে এই প্রশ্ন জাগে কিন্তু তার কোনো সমাধান পায় না, তারা জানে না যে, অর্জুনকে গীতার জ্ঞান প্রদানের পূর্বেই শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত সবাইকে ফ্রিজ অর্থাত স্ট্যাচু করে রেখে দিয়েছিলো, তাই তারা কেউ কৃষ্ণের মুখে গীতার বানী শুনতে পায় নি এবং তার বিশ্বরূপও দেখতে পায় নি। অর্জুনের সাথে যখন কৃষ্ণের কথাবার্তা শেষ হয়, তখন কৃষ্ণ সবাইকে মুক্ত করে দেয় এবং যুদ্ধ শুরু হয়। কৃষ্ণ যদি সর্বশক্তিমান ঈশ্বর না হয়, তাহলে এটা সে কিভাবে ঘটাতে পারলো ?
যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে, যখন শুধু দুর্যোধন জীবিত, তখন গান্ধারী, বেদব্যাসের কাছে যায়, তার একটি পুত্রকে কোনোভাবে জীবিত রাখা যায় কি না, সেই উপায় জানতে; অতঃপর বেদব্যাসের বলা কথা গান্ধারীর মুখে শুনে শকুনি বুঝতে পারে যে, গান্ধারী, সারাজীবন ধরে চোখ বেঁধে রাখায়, তার দেহে এক ধরণের শক্তি উৎপন্ন হয়েছে, তাই গান্ধারী যদি একবার চোখ খুলে দুর্যোধনের দিকে তাকায়, তাহলেই দুর্যোধনের শরীর বজ্রের মতো হয়ে যাবে এবং কোনোভাবেই কেউ আর তাকে হত্যা করতে পারবে না। এরপর গান্ধারী, তার ছেলেকে বজ্রের শরীর দেওয়ার পরিকল্পনা করে। এমনটা হলে দুর্যোধনকে কেউ হত্যা করতে পারবে না এবং সমাজে ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হবে না, এটা বুঝতে পেরে কৃষ্ণ, দুই জায়গায় থাকা শকুনি ও দুর্যোধনের সাথে একই সময় কথা বলতে থাকে এবং সেই চেষ্টা করতে থাকে, যাতে দুর্যোধনের শরীরের কোনো একটা জায়গা দুর্বল থাকে। কৃষ্ণ, দুর্যোধনকে বলে, সে যদি সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে তার মায়ের সামনে যায়, তাহলে তার মাতৃহত্যার পাপ হবে, এর ফলে দুর্যোধন কোমড়ে কলা পাতা পেঁচিয়ে গান্ধারীর সামনে যায় এবং উরু ছাড়া তার সারা শরীর বজ্রে পরিণত হয়।
কৃষ্ণ যদি সর্বশক্তিমান ঈশ্বর না হয়, তাহলে সে কিভাবে একই সময়, দু জায়গায় দুজনের সাথে কথা বলতে পারলো ? দুর্যোধন যখন, গান্ধারীর শিবিরে, নিজের বজ্রের শরীর বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, সেই সময় শকুনি তার শিবিরে কৃষ্ণের সাথে পাশা খেলছিলো। কিন্তু কৃষ্ণ, সর্বজ্ঞানী হওয়ায় দুর্যোধনের বজ্রের শরীর হওয়ার বিষয়টা আগেই জেনে যায় এবং শকুনির সাথে পাশা খেলার অবস্থাতেই গান্ধারীর শিবিরে দুর্যোধনের সামনে উপস্থিত হয়ে তাকে উপর্যুক্ত কথাগুলো বলে। কৃষ্ণ সর্বজ্ঞানী হওয়াতেই শকুনির সেই প্ল্যান ব্যর্থ হয়, যা প্রমান করে যে শ্রীকৃষ্ণই ঈশ্বর।
এর আগে যুদ্ধের ১৩ তম দিনে, দুর্যোধনের ভগ্নিপতি জয়দ্রথের তপস্যার শক্তির প্রভাবে এবং শকুনির পরিকল্পনায় কৃষ্ণ ও অর্জুনকে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে রেখে, যখন সবাই মিলে অর্জুনের ছেলে অভিমন্যুকে হত্যা করে, তার বদলা নেওয়ার জন্য অর্জুন, পরের দিন জয়দ্রথকে হত্যার প্রতিজ্ঞা করে এবং সূর্যাস্তের পূর্বে তাকে হত্যা করতে না পারলে, সে নিজেই প্রাণ দেবে বলে শপথ নেয়। তাই জয়দ্রথকে হত্যার জন্য অর্জুন দুর্দান্ত গতিতে যুদ্ধ করতে থাকে কিন্তু জয়দ্রথ নিজেকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে থেকে দূরে শিবিরে সৈন্য পরিবেষ্টিত অবস্থায় অবস্থান করতে থাকে, তার উদ্দেশ্য হলো সূর্যাস্ত শেষে যুদ্ধ শেষ হলেই সে কেবল শিবির থেকে বেরুবে, আর অর্জুন তাকে হত্যা করতে পারবে না।
কৃষ্ণ এই প্ল্যান বুঝতে পেরে, সূর্য অস্ত যাওয়ার কিছু পূর্বেই তার সুদর্শন চক্র দ্বারা সূর্যকে ঢেঁকে দেয় এবং সূর্য আড়াল হওয়ায় অন্ধকার নেমে আসে এবং সবাই মনে করে সূর্যাস্ত হয়ে গেছে, তাই জয়দ্রথ শিবির থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে এবং অর্জুনকে হত্যা করার আনন্দে ভাসতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ সূর্যাস্ত হওয়ার কারণ শকুনি বুঝতে পারে এবং কৃষ্ণকে বলে, বাসুদেব, তোমার সুদর্শন চক্র সূর্যকে আড়াল করে রেখেছে কেনো ? তখন কৃষ্ণ বলে,
“সূর্যের অস্ত যাওয়া তো রোধ করতে পারি না, কিন্তু সূর্যাস্ত হওয়ার পরিবেশ তো সৃষ্টি করতেই পারি”
এরপর অর্জুন, জয়দ্রথকে বধ করে।
কৃষ্ণ যদি ভগবান না হয়, তাহলে সে কিভাবে সূর্যকে আড়াল করতে পারলো ?
সূর্যের অস্ত যাওয়া তো রোধ করতে পারি না, এই কথার মাধ্যমে এখানে আর একটা বিষয় পরিষ্কার যে, প্রকৃতির নিয়মকে কেউ পাল্টাতে পারে না, কিন্তু তাকে এদিক ওদিক একটু মডিফাই করতেই পারে, যেমন- লোহার ধর্ম কাঠিন্যতা, কিন্তু তাকে গরম কর স্বল্প সময়ের জন্য নরম করা ই যায়।
কেউ কেউ প্রশ্ন করে, শ্রীকৃষ্ণ যদি ঈশ্বর হয়, তাহলে তার যুদ্ধ লাগিয়ে এই বিধ্বংস ঘটানোর দরকার কী ? দরকার এজন্যই যে, প্রকৃতির নিয়ম মেনেই তাকে অধর্মের বিনাশ ঘটাতে হবে। এছাড়াও ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য যদি লোকজন ত্যাগ স্বীকার না করে, তাহলে তার কোনো মূল্য লোকজনের কাছ থাকবে না বা তারা তার কোনো মূল্য দেবে না। যেমন- বিনা পয়সায় অর্জিত বস্তুর মূল্য কারো কাছে থাকে না বা কেউ তার মূল্য দেয় না।
যুদ্ধ শেষে দ্রৌপদী, কৃষ্ণকে প্রশ্ন করেছিলো, সে তো ঈশ্বর, তাহলে কেনো সে মানুষের মন পরিবর্তন না করে এই বিধ্বংস ঘটালো ?
শ্রীকৃষ্ণ উত্তর দিয়েছিলেন, জন্ম নেওয়ার পর মানুষ স্বতন্ত্র হয়ে যায়, কোনো শক্তি তার ইচ্ছার উপর দিয়ে আর কিছু করতে পারে না। তাই একবার যাকে যে অবস্থায় সৃষ্টি করা হয়েছে, সেইভাবেই তাকে তার কাজ করতে দিতে হয় এবং এভাবেই সে এক সময় ধ্বংস প্রাপ্ত হয়, এজন্যই এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে।
কর্ণ, নিজের পরিচয় আড়াল করে মিথ্যা বলে পরশুরামের কাছ থেকে অস্ত্র শিক্ষা লাভ করেছিলো। শেষে পরশুরাম যখন বিষয়টা জানতে পারে, তখন কর্ণকে বলেছিলো, তুমি মিথ্যা বলে বিদ্যা লাভ করেছো, এজন্য তোমার যখন চরম সংকট কাল উপস্থিত হবে, তখন এই বিদ্যা তোমার কোনো কাজে লাগবে না; কিন্তু এই কথা কর্ণ ও পরশুরাম ছাড়া আর কেউ জানতো না। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে চুড়ান্ত পর্যায়ে, কর্ণ যখন অর্জুনের সম্মুখীন হয়, তখন কর্ণ তার যুদ্ধ বিদ্যাকে স্মরণ করতে পারে না, তখন কর্ণ নিজে থেকেই বলে কেনো আমার একরম হচ্ছে ? জবাবে কৃষ্ণ বলে, স্মরণ করে দেখুন, আপনার গুরু আপনাকে কী অভিশাপ দিয়েছিলো ? চুড়ান্ত মূহুর্তে আপনি তো আপনার বিদ্যাকে স্মরণ করতে পারবেন না, এমনই তিনি বলেছিলেন, তাই না ?
কৃষ্ণ, সর্বজ্ঞানী এবং সর্বশক্তিমান বলেই তিনি অতীত ও ভবিষ্যৎ সব কিছু জানতেন, সেজন্যই কৃষ্ণ জানতেন যে, কর্ণের উপর তার গুরুর কী অভিশাপ আছে। কৃষ্ণ যদি ঈশ্বর না হয়, তাহলে সে কিভাবে কর্ণের এই অভিশাপের কথা জানতে পারলো, যার কথা কর্ণ ও পরশুরাম ছাড়া কেউ জানতো না ?
যুদ্ধের এক পর্যায়ে ভীষ্ম, পাণ্ডব সৈন্যদেরকে মেরে সাফ করে দিচ্ছিলো। সেই সময় ভীষ্ম, যুদ্ধক্ষেত্রে কৃষ্ণের মুখোমুখি হয়, তখন কৃষ্ণ ভীষ্মকে বলে, আপনি ধর্ম প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে আছেন, তাই অস্ত্র ফেলে দিয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নিন। তর্ক বিতর্কের এক পর্যায়ে ভীষ্ম বলে, আমি ইচ্ছা মৃত্যুর বরদান প্রা্প্ত এবং কেউ আমাকে হত্যা করতে পারবে না। কৃষ্ণ বলে, আমি আপনাকে হত্যা করতে পারি এবং কোনো রকম অস্ত্র ছাড়াই শুধু এই রথের চাকা দিয়ে। এতে ভীষ্ম ক্ষেপে গিয়ে কৃষ্ণের দিকে তীর ছুঁড়ে মারে এবং সেই তীর শ খানেক হয়ে কৃষ্ণের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, কিন্তু কৃষ্ণের গায়ে লাগার পূর্বেই সেগুলো এক জায়গায় শূন্যে স্থির হয়ে যায়। তখনই ভীষ্ম বুঝতে পারে যে, শ্রীকৃষ্ণই পরমব্রহ্ম পরমেশ্বর এবং তার পর কৃষ্ণের কাছে ভীষ্ম নতি স্বীকার করে মৃত্যুকে বরণ করে নেয়।
কৃষ্ণ, ভগবান না হলে এই তীরগুলো সে কিভাবে আটকালো ?
যুদ্ধ শেষ হলে গান্ধারী, কৃষ্ণকে বলে- আপনি তো পরমেশ্বর, আপনি চাইলেই এই যুদ্ধ বন্ধ করতে পারতেন এবং আমার শতপুত্রকে বাঁচাতে পারতেন, কিন্তু আপনি তা করেন নি, এজন্য আপনাকে আমি অভিশাপ দিচ্ছি, আমার বংশ যেমন ধ্বংস হয়েছে, আপনার বংশও ধ্বংস হবে এবং আপনি নিঃসঙ্গ অবস্থায় বনে এক ব্যাধের তীরে নিহত হবেন। কৃষ্ণ তা মেনে নিয়ে বলেছিলেন, শতপুত্র হারানোর যে কষ্ট আপনি পেয়েছেন, সেই কষ্ট আমারই, দুর্যোধনের মৃত্যু যন্ত্রণা, আমারই যন্ত্রণা; কারণ, আমিই দুর্যোধন, আর আমি ই অর্জুন, জগতে এমন কিছু নেই যা আমি নই, আমি ই জড় ও চেতন জগতের সব কিছুর উৎস, সব কিছু আমা হতেই প্রবর্তিত হয় এবং আমাতেই বিলীন হয় (গীতার ১০ম অধ্যায়ের সারাংশ)।
কেউ যদি সর্বজ্ঞানী ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বর না হয়, সে কিভাবে এসব কথা বলতে পারে ?
এই রকম আরো বহু ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়, যাতে প্রমান হয় যে, শ্রীকৃষ্ণই সর্বজ্ঞানী এবং সর্বশক্তিমান ঈশ্বর। কিন্তু কেউ কেউ বলবে, এগুলো তো সবই গল্প। গল্প তো বটেই, কোরান-হাদিস, বাইবেল ত্রিপিটকের গল্পগুলো কি গল্প নয় ? ওগুলো যে সত্য তার কি কোনো চাক্ষুষ প্রমান আছে, না আপনি সেগুলো ঘটতে দেখেছেন ? বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে তাদের সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে যা বলা আছে, সেই সৃষ্টিকর্তাকে প্রমান করতে হলে তো সেই গ্রন্থগুলোর ঘটনাকেই অবলম্বন করতে হবে। এইভাবে আমি বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমান করে দিলাম যে, হিন্দু শাস্ত্রে বলা মানবরূপে জন্ম গ্রহণকারী শ্রীকৃষ্ণই ঈশ্বর। এখন যদি কারো ক্ষমতা থাকে তো, আমার এইসব বক্তব্যকে খণ্ডন করুক।
উপরের আলোচনায় ভগবান এবং ঈশ্বর এই দুটি শব্দ বার বার ব্যবহার করা হয়েছে এবং এই দুটি শব্দ দ্বারাই শ্রীকৃষ্ণকে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু ভগবান এবং ঈশ্বর দ্বারা একই অর্থ প্রকাশ করে না। যারা আমার পুরোনো পাঠক, তারা অবশ্যই এই দুই শব্দের পার্থক্য জানেন। শুধু নতুনদের উদ্দেশ্যে বলছি- যশ, শ্রী, জ্ঞান, বীর্য, ঐশ্বর্য, বৈরাগ্য- এই ৬টি গুন থাকলে তাকে ভগবান বলা হয়, কিন্তু সবগুন থাকলে তাকে ঈশ্বর বলা হয়। কিন্তু যার মধ্যে সব গুন থাকবে, তার মধ্যে তো ৬ টি গুন থাকবেই, এজন্যই শ্রীকৃষ্ণকে একই সাথে ঈশ্বর এবং ভগবান বলা হয়; কিন্তু অন্য অবতারগন শুধুমাত্র ভগবান, ঈশ্বর নয়; কারণ, তারা কেউ বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার ছিলেন না, ছিলেন আংশিক অবতার। বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার শুধুমাত্র শ্রীকৃষ্ণ এবং একারণেই তাকেই পূর্ণব্রহ্ম বা পরমেশ্বর বলা।
জয় শ্রী কৃষ্ণ।কালেক্ট মেঘাদ্রিতা মেঘ   

https://www.facebook.com/sonatondharmo.blogspot/

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ